বাঙালির ঐতিহ্য খাদি কাপড়
পাতলা খাদির জন্য যে ‘অম্বর চরকা’য় কাটা সুতার দরকার পড়ে সেটা আমাদের দেশে হয় না বলে দেশের মানুষ খাদি বলতে শুধু মোটা কাপড়ের শীতকালীন পোশাককেই মনে করতেন এতদিন। তবে প্রযুক্তির কল্যাণে এবং কিছু শিল্পানুরাগী ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতায় খাদি পেয়েছে পুনর্জন্ম। খাদি কাপড়ের তৈরি বাহারি শাড়ি, ওড়না, স্কার্ট, টপ, আউটারওয়্যার, কটি, পায়জামা, পর্দা, কুশন কভার, জ্যাকেট বছরজুড়ে থাকছে দেশীয় পণ্যে হিসেবে সর্বস্তরের মানুষের আগ্রহের পুরোটাজুড়েই। সেই সঙ্গে ঢাকাই মসলিনের মতো হারাতে বসার সেই কালবেলাতেও টিকে থাকা খাদি কাপড়ের পাঞ্জাবি এবং খাদির শাল তো আছেই। ফ্যাশন ডিজাইনারস কাউন্সিল অব বাংলাদেশ প্রতিবছর আয়োজন করে আসছিল খাদি নিয়ে জমকালো ফ্যাশন শো ও প্রদর্শনীর। আবার তাদের উদ্যোগে খাদি কাপড়ে ফ্যাশনেবল কাজ করায় নতুন প্রজন্মের কাছে খাদি গ্রহণীয় হয়ে উঠছে দিনকে দিন। ফলে খাদি কাপড় দেশের বাজার ছাপিয়ে স্পেন, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, তুরস্কসহ বেশ কয়েকটি দেশের বাজারে বাংলার সমৃদ্ধ ইতিহাসের বার্তা বহন করে চলেছে।
তীব্র প্রতিযোগিতার এ যুগে কলে বোনা কাপড়ের কাছে স্থানীয় ক্ষুদ্র খাদি শিল্প মুখ থুবড়ে পড়লেও ভারতীয় উপমহাদেশের তাঁত শিল্প প্রাচীনকাল থেকেই ছিল জগদ্বিখ্যাত। স্থানীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি তাঁতে বোনা হতো বিশ্বমানের কাপড়। দেশের মানুষের চাহিদা মেটানোর পরে সেসব কাপড় আবার বিদেশেও রপ্তানি হতো।
তবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের যুগে ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর দেয়া ‘স্বদেশী পণ্য গ্রহণ করো, বিদেশি পণ্য বর্জন করো’ স্লোগানের পর থেকে স্থানীয় খাদি কাপড়ের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে বলে মনে করেন ঐতিহাসিকরা। বর্তমানেও বাংলাদেশের কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ের রামঘাটলা এবং চান্দিনা, দেবীদ্বার ও মুরাদনগর উপজেলায় টিকে আছে সহস্রাধিক তাঁতি পরিবার। তারা প্রাণপণে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছেন বাপ-দাদার আমলের এ শিল্পকে। সেই সঙ্গে চেষ্টা করছেন এ শিল্পকে ঘিরে অর্জন করা দেশের সুনামকেও টিকিয়ে রাখতে। কিন্তু কাপড় তৈরিকরণ কাঁচামালের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি ও চড়াদামে ভোক্তাদের আগ্রহ হারানো, কারখানায় তৈরি খাদির আদলে তৈরি কাপড়কে তুলনামূলক কম মূল্যে তাঁতে বোনা খাদি কাপড় বলে চালানো, তৈরি পোশাক শিল্পে উত্তরোত্তর সাফল্য এবং যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে খাদি কাপড়ের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। বেশিরভাগ তাঁতিরা পেশা ছেড়ে বাধ্য হয়ে চলে যাচ্ছেন অন্য কোনো পেশায়।
আবার কাপড়ের মান বাছবিচার না করে শুধু মোটা-চিকনের নিরিখে খাদি কাপড়ে আগ্রহ দেখানোতে খাদি সুতা ও কলে তৈরি সুতার মিশ্রণে তৈরি হচ্ছে বর্তমান খাদিবস্ত্র। ফলে খাদি কাপড় হারাতে বসছে তার শুধু হাতে তৈরি অনন্য কাপড়ের গৌরব। সম্ভাবনাময় খাদির পুনর্জন্মের ও কর্মসংস্থান থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন হাজার হাজার দক্ষ পুরুষ ও মহিলা শ্রমিক। সেই সঙ্গে বন্ধ হতে বসেছে গৃহস্থালি কাজের ফাঁকে তাদের বাড়তি আয়ের সুযোগও। বাঙালির শত বছরের এ ঐতিহ্য যেন হারিয়ে না যায়, পাশাপাশি যুগোপযোগী নকশা ও মান যেন ধরে রাখতে পারে, সেজন্য দরকার সরকারি ও ব্যক্তিপর্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতা। খাদির সঙ্গে যুক্ত তাঁতশিল্পীদের বিনা সুদে বা কম সুদে ঋণ দেয়া এবং খদ্দর কাপড় তৈরির কাঁচামালের দাম নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা দরকার গুরুত্বসহকারে।
জিওগ্রাফিকাল আইডেন্টিফিকেশন বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেলে খাদি শিল্প পাবে বৈশ্বিক পরিচিতি। পর্যটনকেন্দ্রিক ব্যবসাসহ সম্ভব হবে বড় পরিসরে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি করার। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডকে এগিয়ে আসা জরুরি। ভবিষ্যতে খাদি টিকিয়ে রাখতে এসব উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি বছরে অন্তত একটি করে হলেও এ কাপড়ের তৈরি পোশাক সবার কেনা প্রয়োজন। মহাজন ও মধ্যস্বত্বভোগীদের একচেটিয়া প্রভাব নিয়ন্ত্রণও খাদি শিল্পে চলমান সংকট নিরসনে অন্যতম দিশা হতে পারে।